১. ধ্বনি বলতে কী বোঝায় ?
উঃ বাগ যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত বর্ণকে ধ্বনি বলা হয় । মনের ভাব প্রকাশের জন্য শব্দ বা আওয়াজের মাধ্যমে আমরা ধ্বনি উচ্চারণ করি । অধ্যাপক মিহির চৌধূরী কামিল্যা এর মতে - "মানুষের ইচ্ছায়, তার গলা থেকে নিঃসৃত স্বর, বায়ুস্তরে শোনার মতো যে স্পন্দন তোলে, তাকে বলে 'ধ্বনি' ।" যেমনঃ অ, আ, ই, উ, এ, ঔ, ক, গ, শ - এদের উচ্চারণ টুকু ।
এক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন ভাষা ও ছন্দ-বিজ্ঞানে পশুপাখির ডাক বা পদার্থের আঘাতে সৃষ্ট ধ্বনিকে 'ধ্বনি' বলে না । শুধুমাত্র মানুষের কণ্ঠজাত ধ্বনিই 'ধ্বনি' ।
২. ভাষায় ধ্বনির গুরুত্ব কিরূপ ?
উঃ ধ্বনি হল ভাষার ক্ষুদ্রতম অংশ তথা ভাষার মূল উপকরণ ।
৩. ধ্বনি ও বর্ণের সম্পর্ক কিরূপ ?
উঃ ধ্বনির কোন রূপ থাকে না, আবার মুখনিঃসৃত ধ্বনির কোন প্রতীকও নেই কিন্তু ধ্বনি যখন লিখে উপস্থাপন করা হয় তখন দৃষ্টিগ্রাহ্য যে চিত্র ব্যবহার করা হয় তাই ধ্বনির প্রতীক । এই প্রতীককে 'বর্ণ' বলা হয় ।
৪. ধ্বনি কয় প্রকার ও কীকী ?
উঃ উচ্চারণের সময় শ্বাসবায়ুর গতিপথ, বাধার স্থান, পরিমাণ ও প্রকৃতিকে মানদণ্ড হিসাবে গ্রহণ করে ডঃ রামেশ্বর শ' তার "সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা" নামক গ্রন্থে ধ্বনি কে তিনটি প্রধান গোত্রে বিভক্ত করে মোট ছয় ভাগে বিভক্ত করেছেন । এই প্রধান গোত্র তিনটি হলঃ (১) অন্তর্গামী ও বহির্গামী ধ্বনি (Ingressive and Aggressive Sounds), (২) বিভাজ্য ও অবিভাজ্য ধ্বনি (Segmental and Supra-segmental Sounds) এবং (৩) সঘোষ ও অঘোষ ধ্বনি (Voiced and Voiceless Sounds)।
৫. অন্তর্গামী ও বহির্গামী ধ্বনি (Ingressive and Aggressive Sounds) বলতে কী বোঝায় ?
উঃ ফুসফুস, ঊর্ধ্বকণ্ঠ, মুখগহ্বর ইত্যাদির মধ্যবর্তী শূন্যস্থান প্রসারিত হলে ঐ শূন্যস্থানে বাইরের বায়ু প্রবেশ করে যে ধ্বনির উৎপত্তি ঘটে তাকে অন্তর্গামী বা অ-ঘনীভূত বায়ুজাত ধ্বনি বলে । যেমনঃ চু-চু ।
ফুসফুস, ঊর্ধ্বকণ্ঠ, মুখগহ্বর ইত্যাদির মধ্যবর্তী শূন্যস্থান সংকোচিত হলে ঐ শূন্যস্থানে অবস্থিত শ্বাসবায়ু মুখ বা নাসিকা দিয়ে নির্গত হয়ে যে ধ্বনির সৃষ্টি করে তাকে বহির্গামী ধ্বনি বা ঘনীভূত বায়ুজাত ধ্বনি বলে । যেমনঃ অ, আ, ক্, চ্, প্, ম্ ইত্যাদি ।
৬. বিভাজ্য ও অবিভাজ্য ধ্বনি (Segmental and Supra-segmental Sounds) বলতে কী বোঝায় ?
উঃ কোন বাক প্রবাহকে বা বাক্যকে বিশ্লেষণ করলে যে ধ্বনিগুলিকে পৃথক পৃথক এককে চিহ্নিত করা সম্ভব হয় তখন তাদের বিভাজ্য ধ্বনি বলা হয়; আবার আবার বাক্যে অবস্থিত বাক্যের অর্থ নির্দেশকারী কিছু ধ্বনি যাদের সুস্পষ্ট এককে বিভক্ত করা যায় না সেগুলিকে বলা হয় অবিভাজ্য ধ্বনি ।
যেমনঃ 'রাম যায় ?' ও 'রাম যায় ।' এই বাক্য দুটি কে বিশ্লেষণ করলে র্+আ+ম্ এবং য্+আ+য়্ এই ধ্বনি গুলি পাওয়া যায় যা বিভাজ্য ধ্বনি । আবার ঐ দুটি বাক্যকে উচ্চারণ করার সময় একটি বাক্য দ্বারা জিজ্ঞাসা করা হয় এবং অন্য বাক্যটি সাধারণ বিবৃতিমূলক ইতিবাচক বাক্য । একই বাক্যের দুই বা ততোধিক ধরনের উপস্থাপনের ক্ষেত্রে যে ধ্বনি টি কার্য করে সেটিই অবিভাজ্য ধ্বনি । ইহা সর্বদা অদৃশ্য থেকে ভাষায় ছন্দের ধর্ম সঞ্চার করে ।
৭. সঘোষ ও অঘোষ ধ্বনি (Voiced and Voiceless Sounds) বলতে কী বোঝায় ?
উঃ শ্বাসবায়ুর যাতায়াতের পথে স্বরতন্ত্রীতে বাধার মাত্রাভেদ অনুযায়ী ধ্বনি চারটি শ্রেণীবৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়, যথাঃ স্পর্শ্ব ধ্বনি, সঘোষ ধ্বনি, ফিশফিশে ধ্বনি ও অঘোষ ধ্বনি ।
কোন ধ্বনি উচ্চারণের সময় যদি স্বরতন্ত্রীদুটির কম্পনের ফলে সৃষ্ট স্বর (ঘোষ বা নাদ) যুক্ত হয়ে নির্গত হয় তখন সেই ধ্বনি কে সঘোষ ধ্বনি বলা হয় । বাংলা বর্গীয় ধ্বনির তৃতীয় চতুর্থ ও পঞ্চম ধ্বনি; র্, ল্, হ্, ড়্, ঢ়্ ওয়্, য়্; সমস্ত স্বরধ্বনি সঘোষ ধ্বনির উদাহরণ ।
এবং কোন ধ্বনি উচ্চারণের সময় যদি এই ঘোষ বা নাদ যুক্ত না থাকে তখন তাকে অঘোষ ধ্বনি বলা হয় । বাংলা বর্গীয় ব্যঞ্জনধ্বনির প্রথম ও দ্বিতীয় ধ্বনি এবং স্, শ্ হল অঘোষ ধ্বনির উদাহরণ ।
৮. স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনি কী ?
উঃ ধ্বনিসত্বার রূপ অনুযায়ী বিভক্ত 'বিভাজ্য ধ্বনি'র দুটি প্রধান রূপ হিসাবে অ) স্বরধ্বনি ও আ) ব্যঞ্জনধ্বনি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ।
৯. স্বরধ্বনি বলতে কী বোঝায় ?
উঃ সাধারণভাবে স্বরধ্বনির সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলা যায়, 'অপর ধ্বনির সহায়তা ব্যতীত যে ধ্বনি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও পরিস্ফুটরূপে উচ্চারিত হতে পারে এবং যাকে আশ্রয় করে অপর ধ্বনি উচ্চারিত হয়, তাকে স্বরধ্বনি বলে ।' আবার উচ্চারণ প্রক্রিয়ার দিক থেকে স্বর ও ব্যঞ্জনের পার্থক্য নির্দেশ করে স্বরধ্বনির সংজ্ঞাটি হল - ' যে ধ্বনি উচ্চারণের সময় শ্বাসবায়ু মুখবিবরে কোনরকম বাধা পায় না তাকে স্বরধ্বনি বলে ।' যেমনঃ অ, আ, অ্যা, এ, ও ইত্যাদি ।
১০. ব্যঞ্জনধ্বনি বলতে কী বোঝায় ?
উঃ সাধারণভাবে ব্যঞ্জনধ্বনির সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলা যায়, 'স্বরধ্বনির সহায়তা ব্যতীত যে ধ্বনি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও পরিস্ফুটরূপে উচ্চারিত হতে পারেনা এবং যে ধ্বনি অপর ধ্বনিকে আশ্রয় করেই উচ্চারিত হয়, তাকে ব্যঞ্জনধ্বনি বলে ।' আবার উচ্চারণ প্রক্রিয়ার দিক থেকে স্বর ও ব্যঞ্জনের পার্থক্য নির্দেশ করে ব্যঞ্জনধ্বনির সংজ্ঞাটি হল - ' যে ধ্বনি উচ্চারণের সময় শ্বাসবায়ু মুখবিবরে কোনরকম বী কোন স্থানে বাধাপ্রাপ্ত হয় তাকে ব্যঞ্জনধ্বনি বলে ।' যেমনঃ ক (ক্+অ), চ (চ্+অ), প (প্+অ), চি (চ্+ই) ইত্যাদি ।